বাভাস
বাংলাভাষা সমিতির পত্রিকা
বাংলাভাষা সমিতির পত্রিকা
১ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা
আগস্ট ২০১১
বাভাস
সবটা ঠিক ঠিক পড়তে হলে নীচের লিংক থেকে ফন্ট ডাউনলোড করে নিন অহনলিপি ফন্টটি নিজের উইন্ডোজ ফন্ট ফোল্ডারে ড্রাগ এ্যান্ড ড্রপ করে নিতে হবে প্রথমে পড়ে নিন
Read me First ফাইলটি
অহনলিপি-বাংলা১৪ ডিফল্ট ইন্টারনেট সেটিং
(AhanLipi-Bangla14 Default Internet
setting)
(Default font setting ডিফল্ট ফন্ট সেটিং)
on
internet(Mozilla Firefox)
(top
left) Tools
Options > contents
Fonts & Colors
Default font:=AhanLipi-Bangla14
Advanced...
Fonts for:
=Bengali
Proportional
= Sans Serif, Size=20
Serif=AhanLipi-Bangla14
Sans
Serif=AhanLipi-Bangla14
Monospace=AhanLipi-Bangla14, Size=20
-->OK
Languages
Choose your preferred Language for
displaying pages
Choose
Languages in order of preference
Bengali[bn]
-->OK
--> OK
এবারে
ইন্টারনেট খুললে ‘অহনলিপি-বাংলা১৪’ ফন্টে সকলকিছু দেখা যাবে নেটে একই ফন্টে সব কিছু লেখাও যাবে
মোদের দাবি একটাই
সকল কাজে বাংলা চাই
বাংলাভাষা
সমিতির পত্রিকা
সমিতির পত্রিকা
বাভাস আগস্ট ২০১১--রবীন্দ্র সংখ্যা
এবারে ১৬+১৬=৩২ পৃষ্ঠা
পত্রিকায় রবীন্দ্র বিষয়ক
মোট ২০টি ছবি মুদ্রিত হয়েছে--
১১৯৩০ সালে জার্মান যুবকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ।
২মৃত্যু ও রবীন্দ্রনাথ- নিবন্ধের প্রাসঙ্গিক চিত্র
৩বিদেশে রবীন্দ্রনাথ
৪জগৎসভায় রবি
৫সপরিবার রবীন্দ্রনাথ
৬ডাকঘর নাটকে রবীন্দ্রনাথ
৭শিশু মনে রবির কিরণ- নিবন্ধের প্রাসঙ্গিক চিত্র
৮শিশু মনে রবির কিরণ- নিবন্ধের প্রাসঙ্গিক চিত্র
৯কর্মরত রবীন্দ্রনাথ
১০কবি এ্যানা ডি নোআই-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ
১১রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি, বাংলাদেশ
১২দুই পাশে দুই শিশু কন্যা সহ যুবক রবীন্দ্রনাথ
১৩রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ও কনিষ্ঠ সন্তান শমীন্দ্রনাথ
১৪এলম্হার্স্টের সঙ্গে কবি
১৫রবীন্দ্রনাথের পাশে দেখানো নোবেল পুরস্কার
১৬বিদেশে
১৭টোকিওতে রবীন্দ্রনাথ
১৮তেহরানে কবি
১৯নববর্ষের প্রার্থনা শেষে আম্রকুঞ্জের দিকে কবি
২০কবি ও হেলেন কেলার
প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে__
কে তুমি,
মেলে নি উত্তর
বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিমসাগরতীরে,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়__
কে তুমি,
পেল না উত্তর
====================
বাংলাভাষা সমিতির পত্রিকা
ইন্টারনেট:
মৃত্যু ও রবীন্দ্রনাথ
সুভাষচন্দ্র দত্ত
’মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান ... তুঁহু মম মাধব, তুঁহু মম দোসর, তুঁহু মম তাপ ঘুচাও, মরণ রে তু আও রে আও‘... বিশ্বকবি মৃত্যুকে আহ্বান করেছেন তাঁর অত্যন্ত প্রিয়জন রূপে, যেন মৃত্যু তাঁর শীতল স্পর্শে কবি- হৃদয়ের সমস্ত যন্ত্রণা লাঘব করে দেয় কিন্তু পরক্ষণেই তিনি বলেছেন, ’মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই, ...‘ তিনি বলেছেন, ’আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে‘ ১০ই মার্চ, ১৮৭৫, কবির বয়স যখন মাত্র ১৪ বৎসর, তখন মারা যান তাঁর জননী সারদা দেবী মায়ের মৃত্যু উপলক্ষে কবি লিখেছেন, ’মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে দেহে তাহার কোনও প্রমাণ ছিল না সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে রূপ দেখিলাম তাহা সুখ সুপ্তির মতই প্রশান্ত ও মনোহর‘...
মৃত্যুকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন বার বার মৃত্যু এসে হানা দিয়ে গেছে তাঁর পরিবারে একের পর এক বিশেষ করে, যাঁরা ছিলেন তাঁর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, তাঁদের অকাল প্রয়াণ তিনি মেনে নিতে পারেননি নিজের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, দৌহিত্র, এঁদের একের পর এক মৃত্যু তাঁকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল আর পাঁচজন স্বামীর মতো, পিতার মতো তিনিও বিলাপ করেছেন হতাশাগ্রস্ত কবি উচ্চারণ করেছেন সেই হৃদয়বিদারক বাণী, ’অসীম সংসারে যার কেহ নাহি কাঁদিবার, ... সে আর কিসের আশে রয়েছে সংসারপাশে, জ্বলন্ত পরাণ বহে কিসের আশায়‘ ১৯শে এপ্রিল, ১৮৮৪ আত্মহত্যা করেন নতুন বৌঠান তথা কবির সর্বসময়ের সঙ্গী কাদম্বরীদেবী ২৩শে নভেম্বর ১৯০২(৭ই অগ্রহায়ণ, ১৩০৯) মারা যান কবিপত্নী মৃণালিনীদেবী মাত্র ২৯ বছর বয়সে, কবির তখন বয়স ৪১ বছর তাঁর স্মরণে রচিত কাব্যগ্রন্থ স্মরণ ১৯০৩ সালে ২য়া কন্যা রেণুকার মৃত্যু হয় কবির বিয়ের দিন মারা যান বড় ভগ্নীপতি সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়
আবার পরক্ষণেই মৃত্যুর সুন্দর রূপ ভেসে উঠেছিল তাঁর চোখে, ’তব অন্তর্ধানপটে হেরি তব রূপ চিরন্তন/ অন্তরে অলক্ষ্য লোকে তোমার অন্তিম আগমন লভিয়াছি চিরস্পর্শমণি‘ কিংবা ’আমার আহুতি দিনশেষে/ করিলাম সমর্পণ তোমার উদ্দেশে লহো এ প্রণাম--‘ মৃত্যুকে সকলেই ভয় পায় মৃত্যুভয় কার নেই? মৃত্যু মানে মানুষের মনে ভেসে ওঠে একটা আতঙ্ক মৃত্যু সম্বন্ধে বিশ্বকবির সর্বশেষ উপলব্ধিটুকু লিখে এ প্রসঙ্গের যবনিকা টানব তিনি বলেছেন, ’স্তন হতে তুলে নিলে কাঁদে শিশু ডরে, মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে‘ মৃত্যু নিয়ে এর চেয়ে সহজ উপলব্ধি, এর চেয়ে বড় আশ্বাস আর কি হতে পারে?বাইশে শ্রাবণের এই পুণ্য প্রভাতে প্রণাম জানাই সেই মৃত্যুঞ্জয়কে
-------------------------------------------------------
বাভাস আপনারই পত্রিকা -- আমাদের দ্বার অবারিত
সবাই আসুন, সবাই লিখুন, সবাই নিজের মতামত দিন
-------------------------------------------------------
পৃঃ-২
পৃঃ-২
বাংলাভাষা সমিতির পত্রিকা
আগস্ট-২০১১
আমরা ইতিমধ্যে তিনটি সংখ্যা বের করেছি, তার সবক‘টি আমরা বিনামূল্যে বিতরণ করেছি যাঁরা পাননি তাঁরা দয়া করে আমাদের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করে নেবেন
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ সারা বিশ্ব জুড়ে পালিত হচ্ছে তাঁর বিষয়ে নানা দিক নিয়ে আলোচনা হচ্ছে খ্যাত কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে তাঁর একটি পত্র বিনিময় পাঠকদের সামনে তা তুলে ধরলাম
’কংগ্রেস সভাপতি হিন্দিকেই রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করেছেন এতে বাঙালির কি দুঃখিত হবার কারণ নেই? বহুসমৃদ্ধ বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষা হবার গৌরব থেকে বঞ্চিত হল কোন্ অপরাধে? এ বিষয়ে আপনার অভিমত প্রার্থনা করি ... ২২/২/৩৮ ইং‘ __ সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, সম্পাদক 'পূর্ব্বাশা' (দেশ, সাহিত্য সংখ্যা ১৩৮২[১৯৭৫])
রবীন্দ্রনাথ এর জবাবে লেখেন__
’বাংলা ভাষাকে কন্গ্রেস যদি বিশ্বভারতের রাষ্ট্রভাষা বলে গণ্য না করে__ তাহলে এ নিয়ে আমি আপত্তি করতে পারব না
কন্গ্রেসের কর্তব্য কন্গ্রেসের হাতে আমি সভ্য শ্রেণীতেও নেই__ তোমরা যদি বৃথা চেষ্টা করতে চাও কোরো__ তোমাদের বয়স অল্প, যথেষ্ট সময় আছে ২২/২/৩৮‘__ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(দেশ, সাহিত্য সংখ্যা ১৩৮২[১৯৭৫]), পৃঃ ১৯
আমাদের বাভাস পত্রিকায় যেভাবে লেখাগুলির হরফ গাঁথা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এ রকম প্রশ্ন যে উঠবে তা আমরা অনুমান করে ছিলাম, কারণ সাধারণ লেখালিখির থেকে এটা একটু ভিন্ন রকম এবিষয়ে পাঠকেরা ঠিক কী বলতে চান তা আমাদের লিখে পাঠালে আমরা তার সাধ্য মতো জবাব দেব আপাতত বলা যাক বাংলা লেখাকে আমরা স্বচ্ছ করতে চাই বাংলা এখন শির সমান উঁচু করে বিশ্বের দরবারে হাজির মুখ কাঁচুমাচু করার দিন আর যে নেই
বাভাস-৩
রবীন্দ্রনাথ ও প্রকৃতি
মদনমোহন মৈত্র
আধুনিক যন্ত্রসভ্যতা যখন মধ্যগগনে পাবলো কোহেলো(Publo Cohelo) তাঁর এ্যালকেমিস্ট (Alchemist) উপন্যাসে বললেন, আদিম মানুষ প্রকৃতির অন্তঃস্থলে বাস করত বলে সে অতীন্দ্রিয় শক্তির অধিকারী ছিল প্রকৃতি থেকে অপসারিত মানুষ সে শক্তি হারিয়েছে একদিন মানুষের অভ্যন্তরের শক্তি মানুষকে শুধু প্রকৃতির রোষ থেকেই প্রাণকে আলাদা করেনি, প্রতিনিয়ত তার মেধা ও চেতনাকে উন্মীলিত করেছে পশুপাখি এখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগাম বার্তা পায় আদিম জারোয়া প্রভৃতি আদিম জনগোষ্ঠী এখনও আত্মরক্ষার উপায় সন্ধান করে অতীন্দ্রিয় শক্তির উপর প্রাচীন ভারতবর্ষ প্রকৃতির পাঠশালার সন্ধান পেয়েছিল আর সেই পথেই এমন এক সভ্যতার উন্মেষ ঘটিয়েছিল যা আজও বিস্ময়কর ঠেকে
রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা ও চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে প্রকৃতির অনিবার্যতাকে মনে রেখেই ছাত্রদের গাছের তলায় নিয়ে বসেছেন যেখানে খানিকটা পুথির পড়া আর অনেকটাই চারপাশের আকাশ গাছপালা পশুপাখি আর ঋতু পরিবর্তনের ছন্দ নবীন মনকে কৌতূহলী করেছে তিনি ছিলেন যুগপুরুষ, তাই চিন্তায় ও কর্মে তাঁর অমোঘ মার্গদর্শন ফলবতী হয়েছিল বিশ্বভারতীর মুক্ত ধারায় সেই সৃষ্টিধর্মী শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বকে উপহার দিয়েছে এমন সব সৃষ্টিশীল মণীষীকে যা শতবর্ষ পরেও বিশ্বকে সমৃদ্ধিশালী করে চলেছে
এবার আসি যন্ত্রসভ্যতার রথের প্রগতির কথায় এ কথা শিক্ষার মানের বর্তমান দুর্দশার কাহিনি এ এক বিস্মরণের ইতিহাস যন্ত্রসভ্যতার দানবের কাছে মানুষের আত্মবিসর্জনের করুণ গাথা মানুষ আর তার মন এখন কলকারখানার ’কাঁচামাল‘ প্রসঙ্গত স্মর্তব্য সত্যজিৎ রায়ের ’হীরক রাজার দেশ‘ যন্ত্রের চাকা সচল রাখতে শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়েছে এখন শিশুমনকে এমন এক তালিমের আওতায় আনা হয়েছে যাতে চিন্তার আর কোন অবকাশ না থাকে চিন্তা এখন ’কৃত্রিম মেধা‘ বা Artificial Intelligence-এর এক্তিয়ার ভুক্ত
এখন শিশু যখন শিক্ষা শেষ করে বেরিয়ে আসে, তখন সে পুরোদস্তুর একজন দক্ষ মিস্তিরি, রাঁধুনি, অথবা হিসাবরক্ষক ইত্যাদি তখন তার মন
বাভাস-৪
অবলুপ্ত, লক্ষ্য শুধু অর্থ সংগ্রহ আর ব্যক্তিগত সুখ ’মানে বই‘ আর ’Suggestion ‘-এর উপকরণে সাজানো
প্রয়োগশালার শিক্ষা সৃষ্টিশীল মণীষার বিকাশকে রুদ্ধ করে ’যন্ত্রমানুষ‘ সরবরাহ করেএই ব্যবস্থায় সাহিত্য কলাচর্চা সবই যান্ত্রিক আর প্রাণহীন ব্যবসায়িক পণ্য হয়ে যায় প্রাণ আর যন্ত্রে কোনও অন্তর থাকে না
এই বঙ্গভূমিতে কোনকালেই প্রতিভার অভাব ছিল না, অথচ আজ সর্বক্ষেত্রেই মধ্যমেধার দৌরাত্ম্য বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম বৈজ্ঞানিক ও বিজ্ঞানকর্মীর দেশ ভারতবর্ষ অথচ কত বছর হয়ে গেল এত আয়োজন সত্ত্বেও আর একটাও জগদীশ বসু বা সি ভি রামণ পেলাম না
চিনের নবজাগরণের প্রভাতে রবীন্দ্রনাথ চিনের নবীন প্রজন্মকে সতর্কবাণী শুনিয়েছিলেন এই বলে যে, যন্ত্রের রথের চাকায় প্রাণের স্পন্দন যেন দলিত হয়ে হারিয়ে না যায় নতুন দিনের উন্মাদনায় চিনের ছাত্রসমাজের এক অংশ রবীন্দ্রনাথকে ব্যঙ্গ করেছিল তারা বলেছিল রবীন্দ্রনাথের বাণী নেতিমূলক পরাধীন পরাজিত জাতির প্রতিনিধিকে তারা পশ্চিম সাম্রাজ্যবাদীর ’চর‘ বলে সন্দেহ করেছিল তাঁর ভবিষ্যৎবাণীকে উদ্দেশ্যমূলক বিভ্রান্তিকর বলেছিল কিন্তু কি নিদারুণ সত্য তিনি সেদিন উচ্চারণ করেছিলেন, আজ সংকটের কালো মেঘ সারা বিশ্বকে গ্রাস করেছে চারিদিকে তাজা প্রাণ আনন্দশূন্য অথচ অমৃতপুরুষের দেওয়া আনন্দ ধারা আপন মনে আজও চরাচরের মহাকাশে বয়ে চলেছে
==========================
বাভাস-৫
বিজ্ঞানসাধক রবীন্দ্রনাথ
বরুণ সমাদ্দার
আচার্য জগদীশচন্দ্র একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ’তুমি যদি কবি না হইতে তাহা হইলে শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হইতে পারিতে‘ মন্তব্যটির মধ্যে গভীর তাৎপর্য রয়েছে, যেহেতু উক্তিটি সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতীয় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের স্পষ্ট মতামত আপেক্ষিকভাবে বিজ্ঞান ও সাহিত্য এক বিষয় নয় কিন্তু বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মধ্যে সূক্ষ্মভাবে সাযুজ্য রয়েছে আবার এদের মধ্যে তৈরি হতে পারে অপূর্ব সুন্দর সহমর্মিতা রবীন্দ্রনাথ সে অর্থে একজন সফল পুরুষ যিনি দক্ষতার সঙ্গে বিজ্ঞানকে আলোকিত করেছেন সাহিত্যের সান্নিধ্যে, যার প্রতিফলন তাঁর কাব্য গ্রন্থে বহুলাংশে আলোচিত হয়েছে ’বিশ্বপরিচয়‘ সেই অর্থে একটি গ্রন্থ যেখানে বিশ্বজগতের সৃষ্টিপর্ব ও তার জাগতিক বৈচিত্র তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে ’বনবাণী‘ কাব্যের নটরাজ কবিতাটির মধ্যে পরমাণুর দেহগঠনের আশ্চর্য লীলা ও তাদের খেয়ালি রূপকে কবি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টভঙ্গী দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন
বিজ্ঞান শব্দটি সাধারণ অর্থে বলা হয় বিশেষ জ্ঞান, আবার আধ্যাত্মিক ভাষায় এটির অর্থ ’বোধি‘, অর্থাৎ নির্মলবুদ্ধি ও নির্মল জ্ঞান রবীন্দ্রনাথ সেই অর্থে একজন বিজ্ঞানী যিনি জড় ও অজড় জগতের মধ্যে একটি সুন্দর সহমর্মিতা তৈরি করছেন তিনি বলছেন একটি পাথরের খণ্ডকে গুঁড়ো করলে বস্তুকণা, আবার একটি সজীব প্রাণী বা উদ্ভিদকে যদি ক্রমাগত বিশ্লিষ্ট করা যায় তাহলে পরিণামে একটি বস্তুকণাই পাওয়া যাবে সুতরাং আদি অকৃত্রিম ওই বস্তুকণা যা নক্ষত্রে আছে, যা পৃথিবীর মাটিতে আছে, আকাশেও রয়েছে-- আবার তাই রয়েছে একটি উদ্ভিদে তার ফুলে, ফলে এবং তা রয়েছে আমার তোমার সকলের দেহ মনের মধ্যে এর মধ্যে কোনও বৈপরীত্য নেই এই ভাবরসটির মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ও কুসংস্কারমুক্ত একটি সুস্পষ্ট মতামত পাওয়া যায় এই ভাবনাটির মধ্যে রয়েছে উচ্চনীচ নামাঙ্কিত বর্ণভেদ ও জাতভেদ বৈষম্যের ঊর্ধ্বে তাঁর উৎকৃষ্ট মানবিক চিন্তার অভিপ্রকাশ বিবর্তনবাদ রবীন্দ্রনাথকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল তিনি একজায়গায় বলেছেন, ’আমি বেশ বুঝতে পারছি যে বহু সহস্র বছর আগে পৃথিবীর বুকে আমি একটি গাছ হয়ে জন্মেছিলাম‘ এই উক্তিটির মধ্যে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের একটি অপূর্ব সংহতি ও সাযুজ্য রয়েছে আসলে রবীন্দ্রনাথের চৈতন্য ও সৃজনীশক্তি সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর উপর প্রতিষ্ঠিত জীবন থেকে জীবনবোধ, জীবনবোধ থেকে চৈতন্য, চৈতন্য থেকে অনুভব, অনুভব থেকে সূক্ষ্ম অনুভূতি, সূক্ষ্ম অনুভূতি থেকে সূক্ষ্মাতীত অনুরণন ক্রমান্বিত এই গতিময়তার মধ্য দিয়ে তিনি আবর্তিত হয়েছেন কোনওটাই তাঁর কাছে চরম সত্য বলে কখনওই মনে হয়নি, কেননা জীবন যেমন পরিবর্তনশীল আবার সত্যবোধও কখনও এক জায়গায় থেমে থাকে না এখানেই রবীন্দ্রনাথ একজন সফল বিজ্ঞানী এবং তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ন্যায়সম্মত দর্শন ও বিজ্ঞানচিন্তার উপর প্রতিষ্ঠিত ’একটি গাছের পাতার উপর একটি আলোর নাচুনি‘ এই কবিতাটির মধ্যে যে কী অপার রহস্য লুকিয়ে আছে সেটি অবশ্যই বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত সাহিত্যের সান্নিধ্যে এর সাবলীল প্রকাশ কবিতার ভাবরসকে আরও বেশি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে
=====================
বাভাস-৬
”বঙ্গ ভাষা রাজভাষা নহে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা নহে, সম্মানলাভের ভাষা নহে, অর্থোপার্জনের ভাষা নহে, কেবলমাত্র মাতৃভাষা যাঁদের হৃদয়ে ইহার প্রতি একান্ত অনুরাগ ও অটল ভরসা আছে তাঁহাদেরই ভাষা“
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বৈশাখ ১২৯৯/ (১৮৯২) পৃঃ-৬৯৫, খণ্ড-৪, রবীন্দ্ররচনাবলী (সুলভ সংস্করণ) ১২৫তম রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত, ভাদ্র ১৩৯৪, শক১৯০৯
===================
রবীন্দ্রসংগীত আমাদের মনের আঙিনা আনন্দ-জলে নিকিয়ে দেয় মনের গৃহাঙ্গন পূত পবিত্র করে তোলে
-- সোনালি মুখোপাধ্যায়-- কবিকথার গান টিভিতে ০১/০৯/২০০৯ মঙ্গলবার
=========================
প্রশ্নোত্তর
বিশ্বনাথ মণ্ডল
মাথা ঘোরে বন্ বন্ কান করে কট্ কট্
খিদে পেলে ছোট শিশু কেন করে ছট্ফট্?বাজ পড়া শুনে কারও পিলে কেন চমকায়?
পড়া ফাঁকি দিলে কেন মাস্টারে ধমকায়?
নামতা পড়িলে তবে গুণ ভাগ পারিবে
ব্যাংকে রাখিলে টাকা সঞ্চয় বাড়িবে
আয় কম, ব্যয় বেশি-- এইভাবে চলা দায়
ঋণ নাও শোধ দাও, তাহলে কীসের ভয়?
অভাবে স্বভাব নষ্ট মিছে কেন কষ্ট?
করো কষ্ট পাবে কেষ্ট জেনে রাখো স্পষ্ট
বাভাস-৭
বাংলা লেখা কেমন হবে
মনোজকুমার দ. গিরিশ
পর্ব-২
তৃতীয় শ্রেণিতে পাঠরত ছাত্রীটি অঙ্ক কষতে গিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করল-- বাবা, বাবা ’প্রদত্ত অর্থ তিনটাকা মাত্র‘ লিখতে গিয়ে লিখেছে-- প্রদও অর্থ তিনটাকা মাএ এরকম লিখল কেন?
বাবা তার জবাবে অনেক ব্যাখ্যা করে তাকে কোনও রকমে ব্যাপারটা বোঝালেন ছাত্রী যতটা বুঝল তার চেয়ে বেশি চুপ করে অবাক হয়ে রইল বাংলায় এমন অদ্ভুত ব্যাপার দেখে
বাংলাভাষা সমিতির পত্রিকা ”বাভাস“ ছাপা হচ্ছে যে-লিখন পদ্ধতিতে তা অনেকের পছন্দ হয়নি বরং বলা ভাল বেশিরভাগ লোকেরই তা পছন্দ হবেনা কেন এমনভাবে ”বাভাস“ ছাপা হচ্ছে? তা নিয়ে আলোচনা করা যাক--
আমরা দেখি আমাদের কলেজ ইউনিভার্সিটি যাওয়া মেয়েরা প্যান্ট শার্ট পরে চলাফেরায় কাজে কর্মে দিব্বি ঝকঝকে আধুনিক হয়ে উঠেছে যদিও হয়তো পুরোটা মনে মনে এখনও তেমন মেনে নিতে পারিনি, এসব দেখলে এখনও একটু কষ্ট হয় তবু আপত্তি তেমনটা নেই বাংলা ভাষাকে এমনি প্যান্ট-শার্ট পরা ঝকঝকে আধুনিক করার প্রকল্প নিয়ে এখানে কিছু কথা বলা যাক
শাড়ি পরে বাসে ট্রামে চলতে মেয়েরা নাস্তানাবুদ হয়, তাই তারা আজ আধুনিক উপযুক্ত পোষাক পরছে(ছেলেরা তো ধুতি ছেড়েছে কবে কোন্ কালে) কম্পিউটার, ডেস্কটপ-প্রিন্টিং, ইন্টারনেট, মোবাইল ইত্যাদি ডিজিটাল জগতের আধুনিক বাস-ট্রামে চলতে বাংলা ভাষারও চাই সহজ উপযোগী পোষাক নইলে তাকে সদাই নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে
আগে স্মরণ করি-- ব্র্যাসি হ্যালহেড, চার্লস উইলকিনস্, পঞ্চানন কর্মকার, তাঁর জামাতা মনোহর মিস্ত্রি, এঁর পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র মিস্ত্রি প্রমুখ পুরোধাগণকে, কারণ এঁদের হাতেই বাংলা ছাপার হাতেখড়ি
পানা পুকুরে নামলে যেমন দুহাতে পানা সরিয়ে জল বের করে ডুব দিতে হয়, তেমনি বাংলা ছাপার পানাপুকুরে নামলে অনেক পানা সেখানে দেখা যাবে বাংলা বর্ণ এবং স্বরচিহ্ন ও ফলাগুলিকে লিপিগত ভাবে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, স্বচ্ছ, অর্ধস্বচ্ছ, জটিল-
বাভাস-৮
২অর্ধস্বচ্ছ-- অ, ঘ ঙ ছ জ ঝ ঞ ধ র ল শ ষ ড় ঢ় য় ং ঃ , ে
যে-হরফ বা স্বরচিহ্নগুলির বাহু হরফের মাত্রার উপরে প্রসারিত সেগুলি সবই জটিল যে ফলাগুলি অন্য বর্ণের সঙ্গে পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেগুলি অসম্পূর্ণ তাই জটিল য-ফলা চিহ্নটি য-এর বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এটির হরফ-রূপ স্পষ্ট এবং সরল
বাংলা হরফ এবং ভারতীয় অন্য লিপিগুলির সঙ্গে তুলনা করে এই পর্যায় ভাগ করা হয়েছে
কমপ্লেক্স স্ক্রিপ্ট বা জটিল হরফ ব্যবস্থা যে-সকল বর্ণমালার, সেগুলির মধ্যে বাংলা হরফ লক্ষণীয়ভাবে সরল বিশ্বের প্রায় সকল হরফই জটিল হরফ বা কমপ্লেক্স স্ক্রিপ্ট হিসেবে গণ্য হবে যে-লিপিগুলিতে ভাঁজ কম, অতিরিক্ত বাহু নেই বা কম, মাত্রা নেই সেগুলি সহজে লেখা এবং সহজে পড়া যায়, তাই সেগুলি স্বচ্ছলিপির মধ্যে পড়ে যে লিপিগুলি হরফের মাত্রা ভেদ করে, বা অন্য ধরনের জটিলতা আছে সেগুলি স্বচ্ছ লিপির মধ্যে পড়ে না
বাংলা লিপিসহ ভারতের বেশির ভাগ লিপিরই উৎস হিসেবে ধরা হয় ব্রাহ্মী লিপিকে পাথরে খোদাই ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা একাধিক উদাহরণ পাওয়া গেছে পাথরে খোদাই করতে হত বলে ব্রাহ্মীলিপি ছিল বেশ সরল গঠনেরই পরে তা থেকে বিবর্তিত যেসকল লিপি এসেছে, তার লেখার মাধ্যম গাছের ছাল, পাতা, পশুর চামড়া ইত্যাদি নরম মাধ্যম এসবে লেখাও হত নরম উপকরণ দিয়ে-- কালি, কাঠকয়লা, খাগের কলম, কীলক ইত্যাদি দিয়ে ফলে সহজে লেখার সুযোগ আসায় লেখার সরলতা কমে পেঁচানো ভাব এসে গেল যেমন আগে ব্রাহ্মীলিপিতে ’ক‘ লেখা হত ”“ যেন ঠিক যোগচিহ্ন
(চলবে)
বাভাস-৯
===================
সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির শতবর্ষ(১৯১৩-২০১২) মহাসমারোহে পালন উপলক্ষে উদ্যোগ আয়োজন শুরু হোক ভারত ও বাংলাদেশ এবং ইউনেসকোর তরফে যথাযথ আয়োজন হোক এ বছর রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষ ইউনেসকোর উদ্যোগে সারা বিশ্বে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে
===================
রবীন্দ্রনাথ স্নান করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় নিতেন তিনি সে সময়ে গান রচনা করে সুর দিতেন এভাবে অনেক গান তিনি রচনা করেছেন এবং সুরও দিয়েছেন তাঁর এই দীর্ঘ সময় ব্যয় দেখে স্নানঘরের বাইরে এসে উদ্বিগ্ন কাউকে হয়তো কৌতুক করে বলতেন, তোমরা ভেবেছ লোকটা মরেই গেল বুঝি!
=========================
সহ্য
লিলি হালদার
তোর জন্য সহ্য করি
তপ্ত রৌদ্রদাহতোর জন্য বুকের ভিতর
বৃষ্টি অহরহ
তোর জন্য মাথায় জ্বলে
সৃষ্টির দাবানলতোর জন্য রক্তে এনে
সুধা সে গরল
বাভাস-১০
বাংলাভাষা সমিতির পত্রিকা
আগস্ট-২০১১
======
বাংলাভাষা সমিতি
মণীশ পুরস্কার
২০১১
আদর্শমূলক বিষয়কে তুলে ধরে রচিত
মৌলিক গল্পের জন্য একটি পুরস্কার
পুরস্কার মূল্য ২০০০/-(দুই হাজার)টাকা
শব্দ সংখ্যা সর্বাধিক ২৫০(দুইশত পঞ্চাশ)
পুরস্কার দেওয়া হবে ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১২
”বাভাস“ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাদিবসে
লেখার সঙ্গে-- লেখকের নাম, ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর থাকা চাই
জমাকৃত লেখা হাতে লিখিত হলে তা রুল টানা কাগজের শুধু এক পিঠে এক লাইন ফাঁক দিয়ে দিয়ে লিখতে হবে এবং তা স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন হওয়া চাই
বানান নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে
বিচারক মণ্ডলীর বিচারই চূড়ান্ত
প্রাপ্তলেখাগুলি উপযুক্ত মানের বিবেচিত না হলে পুরস্কার প্রদান স্থগিত থাকবে
পুরস্কার প্রাপ্ত লেখাটি, এবং প্রাপ্ত অন্য লেখাগুলি থেকে নির্বাচিত রচনাগুলি
লেখা জমা দিতে হবে শিবরঞ্জন মণ্ডলের কাছে (হেমচন্দ্র ইনস্টিটিউশন,
ধর্মতলা রোড, কসবা, কোলকাতা-৭০০ ০৪২)
লেখা জমা দেবার শেষ তারিখ ৩১-১২-২০১১
==========================
বাভাস-১২
পাঠক বলেন -- (মতামত)
এই বিভাগে প্রধানত পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা
নিয়ে পাঠক তাঁদের মতামত প্রকাশ করবেন
--নিন্দুক
=====================
☛ বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসার প্রচল ও পরিসেবা বিষয়ে আমরা সকলের কাছ থেকে পরিকল্পনা আহ্বান করছি
পত্রিকা সংগ্রহ ও লেখা জমা দেবার জন্য
শিবরঞ্জন মণ্ডল, সদস্য, বাংলাভাষা সমিতি,
হেমচন্দ্র ইনস্টিটিউশন (১১--১টা)
বাভাস-১৩
তেহরান ইরানের রাজধানী ও প্রধান শহর।
পারস্য ইরানের প্রাচীন নাম।
”আমি এই পারস্যের কল্যাণ কামনা করি । আমাদের প্রতিবেশী আফগানিস্থানের মধ্যে শিক্ষা এবং সমাজনীতির সেই সার্বজনীন উৎকর্ষ যদিচ এখনো ঘটেনি, কিন্তু তার সম্ভাবনা অক্ষুণ্ণ রয়েছে...“
=====================
”পৃথিবী একদিন যখন সমুদ্রস্নানের পর জীবধাত্রীরূপ ধারণ করলেন তখন তাঁর প্রথম যে প্রাণের আতিথ্যক্ষেত্র সে ছিল অরণ্যে। তাই মানুষের আদিম জীবনযাত্রা ছিল অরণ্যচররূপে। পুরাণে আমরা দেখতে পাই, এখন
যে-সকল দেশ মরুভূমির মতো, প্রখর গ্রীষ্মের তাপে উত্তপ্ত, সেখানে এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্ত পর্যন্ত দণ্ডক নৈমিষ খাণ্ডব ইত্যাদি বড়ো বড়ো সুনিবিড় অরণ্য ছায়া বিস্তার করেছিল।“
--- শ্রীনিকেতন হলকর্ষণ-উৎসবে কথিত
বাভাস-১৪
রবির ছবি
শিবরঞ্জন মণ্ডল
রবির ছবি বিরাজ করে,
অন্ধকারে চুপটি ক‘রেঅবহেলার ধূল-চাদরে,
অফিস-ঘরে দেয়াল জুড়ে
বাহান্ন সপ্তাহ ধ‘রে,
রবির ছবি বিরাজ করে
পঁচিশ বোশেখ আগুন ভোরে
বসেন রবি বেদির ‘পরে,গ্রামান্তরে দেশান্তরে,
স্মরণ-ভাষণ ঘরে ঘরে,
নৃত্যে-গীতে পদ্য পড়ে
দিনটি কাটে কী হুল্লোড়ে
দিনেক ভেসে সুখসাগরে
রবি ঠাকুর গেলেন ফিরেআবার রবি বিরাজ করে,
অবহেলার ধূল চাদরে,
বাহান্ন সপ্তাহ ধ‘রে,
রবির ছবি বিরাজ করে
======================
সব সময়ে রুল টানা ফুলস্ক্যাপ কাগজের এক পিঠে, এক লাইন করে ফাঁক দিয়ে দিয়ে স্পষ্ট ভাবে লিখে পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হবে
বাভাস-১৫
বাংলাভাষা সমিতির পত্রিকা, রবীন্দ্র সংখ্যা, ১৪১৮
আগস্ট-২০১১
বাভাস
-------------------------------------------------------
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশতজন্ম বার্ষিকী : স্মরণ --
”বাঙালি বাংলা ভাষার বিশেষত্ব অবলম্বন করিয়াই সাহিত্যের যদি উন্নতি করে তবেই হিন্দিভাষীদের সঙ্গে তাহার বড়ো রকমের মিল হইবে । সে যদি হিন্দুস্থানীদের সঙ্গে সস্তায় ভাব করিয়া লইবার জন্য হিন্দির ছাঁদে বাংলা লিখিতে থাকে তবে বাংলা সাহিত্য অধঃপাতে যাইবে এবং কোনো হিন্দুস্থানী তাহার দিকে দৃক্পাতও করিবে না ।আমার বেশ মনে আছে অনেকদিন পূর্বে একজন বিশেষ বুদ্ধিমান শিক্ষিত ব্যক্তি আমাকে বলিয়াছিলেন, ’বাংলা সাহিত্য যতই উন্নতিলাভ করিতেছে ততই তাহা আমাদের জাতীয় মিলনের পক্ষে অন্তরায় হইয়া উঠিতেছে কারণ এ সাহিত্য যদি শ্রেষ্ঠতা লাভ করে তবে ইহা মরিতে চাহিবে না__ এবং ইহাকে অবলম্বন করিয়া শেষ পর্যন্ত বাংলাভাষা মাটি কামড়াইয়া পড়িয়া থাকিবে এমন অবস্থায় ভারতবর্ষে ভাষার ঐক্যসাধনেরপক্ষে সর্বাপেক্ষা বাধা দিবে বাংলা ভাষা অতএব বাংলা সাহিত্যের উন্নতি ভারতবর্ষের পক্ষে মঙ্গলকর নহে“
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৩১৮/(১৯১১/১২), পৃঃ-৬০৫, খণ্ড-৯, রবীন্দ্ররচনাবলী(সুলভ সংস্করণ) ১২৫তম রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত, ভাদ্র ১৩৯৪, শক ১৯০৯]
=== === === ===
বাংলা বানান নিয়ে এত যে মতান্তর তার মূল কারণটি রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করেই বলেছেন__ "একবার যেটা অভ্যাস হইয়া যায় সেটাতে আর নাড়া দিতে ইচ্ছা হয় না কেননা স্বভাবের চেয়ে অভ্যাসের জোর বেশি...অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে একটা অহংকারের যোগ আছে যেটা বরাবর করিয়া আসিয়াছি সেটার যে অন্যথা হইতে পারে এমন কথা শুনিলে রাগ হয় মতের অনৈক্যে রাগারাগি হইবার প্রধান কারণই এই অহংকার... যাঁরা ইংরাজি শিখিয়া মানুষ হইয়াছেন, তাঁরা বাংলা শিখিয়া মানুষ হইবার প্রস্তাব শুনিলেই যে উদ্ধত হইয়া ওঠেন, মূলে তার অহংকার"--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা শব্দতত্ত্ব (তৃতীয় স্বতন্ত্র সংস্করণ) কলকাতাবৈশাখ-১৩৯১ (১৯৮৪-এপ্রিল), বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ পৃঃ১-২)
=========================
*** যাঁদের কাছ থেকে চিত্র ও তথ্যের ব্যাপারে প্রত্যক্ষ
ও পরোক্ষ সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া গেছে তাঁদের সকলকে অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই ***
-------------------------------------------------------
সম্পাদক:পরিমল রায় কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত
যোগাযোগ: ৯১/২, ডাঃ গিরীন্দ্রশেখর বসু রোড, মণীশ পার্ক, কোলকাতা- ৩৯ ২৩৪৩-৪৬৮৬, মূল্য- ১০/-
--- টুকরো ক‘রে কাছি---
মানস চক্রবর্তী
যতদূর জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ রচিত গানের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার স্বয়ং কবিগুরু ’গীতবিতান‘-এ পূজা, প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ, আনুষ্ঠানিক ও বিবিধ--এই বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর সঙ্গীত রচনার বিন্যাস করে গেছেন কালে কালে কবির এই সার্ধশতবর্ষেও রবীন্দ্রসংগীতের ব্যাপক উন্মাদনা শুধু আমাদের দেশেই নয়, দেশকালের গণ্ডী ছাড়িয়ে প্রসারিত হয়েছে সারা বিশ্বেই রবীন্দ্রানুরাগী অসংখ্য বিদগ্ধ শ্রোতা ও শিল্পী অবশ্য এই মুহূর্তে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনা ও ব্যঞ্জনার ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেশ কিছুটা চিন্তিত ও দ্বিধা-জড়িত বর্তমান সংগীত পরিবেশনায় ও ব্যঞ্জনায় অসঙ্গতিই মূলত তাঁদের এই বিড়ম্বনার কারণ শ্রদ্ধেয় রাজশেখর বসু যেমন বলেছিলেন, ”রবীন্দ্রকাব্যের বাক্যের পরিবর্তন যেমন গর্হিত, রবীন্দ্রসংগীতের সুরের পরিবর্তন বা অলংকরণও তেমনি গর্হিত যিনি মনে করেন, নির্দিষ্ট রীতিতে না গেয়ে রবীন্দ্রসংগীত আরও শ্রুতিমধুর করে গাওয়া যেতে পারে, তাঁর উচিত অন্য গান রচনা করে তাতে নিজের সুর দেওয়া“ যদিও কবিগুরুর প্রথমদিকের বেশির ভাগ সংগীত রচনায় বিশিষ্ট হিন্দুস্থানী গান, পাশ্চাত্য সংগীত ও অন্যান্য প্রাদেশিক সংগীতের সুরের প্রভাব লক্ষ করা যায় পরবর্তী পর্যায়ে অবশ্য হিন্দুস্থানী গান ভেঙে গান রচনার বদলে অধিক সংখ্যায় মূলত রাগ-রাগিনীর ভিত্তিতে তৈরি করেন নিজস্ব সংগীত সম্ভার এই সময়েই কবির কথায় ”যত দৌরাত্মই করি না কেন, রাগরাগিনীর এলাকা একেবারে পার হতে পারিনি দেখলাম, তাদের খাঁচাটা এড়ানো চলে,কিন্তু বাসাটা তাদেরই বজায় থাকে আমার বিশ্বাস, এই রকমটাই চলবে কেন না আর্টের পায়ে বেড়িটাই দোষের, কিন্তু চলার বাঁধা পথটায় তাকে বাঁধে না ... হিন্দুস্থানী গানকে আচারের শিকলে যাঁরা অচল ক‘রে বেঁধেছেন সে ডিক্টেটরদের আমি মানিনে“ তাই সেই সময়ের সংগীত রচনায় অনুকরণের প্রচেষ্টা থাকলেও হিন্দুস্থানী সংগীত পরিবেশনে
বাভাস-ক-১
সুরবিন্যাসের প্রয়োজনে যেসব বাহুল্য সচরাচর লক্ষিত হয়, রবীন্দ্রনাথ সেগুলো বহুলাংশে বর্জন করেছিলেন
কবিগুরুর শেষ যুগের গানগুলো অবশ্য অধিকাংশই অন্যান্য সংগীত-পদ্ধতির প্রভাবমুক্ত খুব সহজ সুর আর সিধে তালের মাধ্যমে পরিণত বয়সে, নানা পরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার শেষে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করে গেছেন বহু গান প্রকৃত বৈশিষ্ট্যসম্মত সেইসব গানই স্বকীয়তায়, বৈশিষ্ট্যে ও বৈচিত্র্যে ভারতীয় সংগীতের বর্ণময় ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের অসামান্য দান রবীন্দ্রসংগীতে ছন্দ-বৈচিত্র্যের ব্যাপকতা ও প্রয়োগও বিস্ময়কর কবি নিজে বলেছেন,”বাংলা কাব্যে ছন্দকে বিচিত্র করতে সংকোচ বোধ করিনি কাব্যে ছন্দের যে কাজ, গানে তালের সেই কাজ তাই ছন্দ যে-নিয়মে কবিতায় চলে, তাল সেই নিয়মে গানে চলবে এই ভরসা করে গান বাঁধতে চাইলেম তাল জিনিসটা সংগীতের হিসাব বিভাগ এর দরকারটা খুবই বেশি সে কথা বলাই বাহুল্য, কিন্তু দরকারের চেয়েও কড়াক্কড়িটা যখন বড়ো হয় তখন দরকারটাই মাটি হতে থাকে“
এই ভাবেই কবি নিজেই কাছিটাকে টুকরো করে খোলা হাওয়ায় সুরের ও ছন্দের আধার সংগীতকেই বিশ্বের দরবারে ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন
===========================
সার্ধ জন্মশতবর্ষে কবিগুরু স্মরণে
ব্যোমকেশ মিশ্র
”ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়
তোমারি হউক জয়“
জ্যোতির্ময় রবীন্দ্রের আবির্ভাবে ভূলোক-দ্যুলোক স্পন্দিত হল নতুন ছন্দে, গানে ও ভাবে বিশ্বমানের মুক্তিমন্ত্রের উদ্গাতা ঋষিকবির কণ্ঠে ধ্বনিত হল-- ”আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি আমার
বাভাস-খ-২
বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি“
ভারত-আত্মার মূর্ত প্রতীক রবীন্দ্রনাথ মানবসভ্যতার অমূল্য সম্পদ তিনি সর্বকালের ও সর্বজনের বৈদিক ঋষির মতো তাঁর ছিল অতলান্ত প্রজ্ঞাদৃষ্টি, বাল্মীকি-বেদব্যাস- কালিদাসের মতো ছিল লোকোত্তর কবি-প্রতিভা, আর ছিল গ্যেটে-টলস্টয়ের মতো সুগভীর সমাজচেতনা সুন্দরের আরাধনায়, মানবতার পূজায় তিনি তাঁর পঞ্চইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে যেন আরতি করে গেছেন তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে গাইতে ইচ্ছে করে--”কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস“
মানবজীবনের এমন কোনও চিন্তা নেই, এমন কোনও ভাব নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি বা নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেননি তিনি মানুষের চিরন্তন সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার পালাগান রচনা করে গেছেন তাঁর কাব্যে ব্যথাহত পাবেন-- ব্যথা বিজয়ের প্রেরণা, দার্শনিক পাবেন প্রকৃত সত্যের সন্ধান, রাজনীতিক পাবেন নির্ভুল পথের নির্দেশ, মৃত্যুপথযাত্রী পাবেন মৃত্যুঞ্জয়ী সান্ত্বনা এক কথায় এই দুঃখদ্বন্দ্বময় নৈরাশ্য-পীড়িত যুগে রবীন্দ্রনাথই আমাদের একমাত্র কল্পবৃক্ষ আমরা তাঁর ভাবতরঙ্গে অবগাহন করি, তাঁর চিন্তা-ধারায় চিন্তা করি, তাঁর সুরে গান গাই, তাঁর ভাষায় কথা বলি তাইতো বিনম্র চিত্তে উচ্চারিত হয়--”তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা, কোন্খানে রাখব প্রণাম“
রবীন্দ্রোত্তর যুগে কবিদের প্রাণের ভাষা যেন মূর্ত হয়ে ওঠে তরুণ কবি সুকান্তের উক্তিতে ”এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে“ ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ গেয়েছেন, ”জগৎ কবি সভায় মোরা তোমারি করি গর্ব বাঙালি আজি গানের রাজা বাঙালি নহে খর্ব“
স্বদেশী যুগের মুক্তিযোদ্ধারা শক্তি ও সাহস পায় কবিগুরুর অগ্নিঝরা দুঃখহরা বাণীতে-- ”উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই“ তাঁর গানে দেশ- প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় --”ও আমার দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা“
বাভাস-গ-৩
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ মণীষীদের অগ্রগণ্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ চিরকালই শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মাতৃভাষাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল মাতৃদুগ্ধে যেমন শরীর পুষ্ট হয়, তেমনি মনের পুষ্টি ও বুদ্ধির বিকাশ ঘটতে পারে একমাত্র মাতৃভাষায় তিনি প্রস্তাব করেছিলেন--”বাংলাদেশে শিক্ষার বাহন হোক বাংলাভাষা“ অবিভক্ত বাংলার কথাই তাঁর চেতনার মূলস্তরে ক্রিয়াশীল ছিল জীবনস্মৃতি গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ”ছেলেবেলায় বাংলা পড়িতেছিলাম বলিয়াই সমস্ত মনটার চালনা সম্ভব হইয়াছিল“ ১৯২৯ সালে অনাথনাথ বসুকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ”বাংলা শিক্ষার ভিতর দিয়ে ছেলেদের মনকে জাগাবার রাস্তা যত প্রশস্ত হয়, এমন আর কোন উপায়ে নয়“
তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন--”আমাদের শিক্ষাকে আমাদের বাহন করিলাম না, শিক্ষাকে আমরা বহন করিয়াই চলিলাম“
আজকের এই অস্থিরতার দিনে, বাঙালির অস্তিত্ব বিলোপের দিনে, মনুষ্যত্ব অবমাননার উগ্র তাণ্ডবের দিনে রবীন্দ্রনাথের স্মরণ, মনন ও নিদিধ্যাসন আমাদের একান্ত প্রয়োজন
ভক্তিবিনম্র চিত্তে প্রার্থনা জানাই-- ”হে নূতন দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ“
সার্ধ জন্মশতবর্ষের শুভক্ষণে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে সবিনয়ে নিবেদন করি--
”শুধু তোমার বাণী নয় হে বন্ধু, হে প্রিয়, মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো“
======================
সার্ধ শতবর্ষে খণ্ডিত রবীন্দ্রতর্পণ
সুভাষ ভদ্র
’মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক
আমি তোমাদেরই লোক
আর কিছু নয়
এই হোক শেষ পরিচয়‘
--বোধ হয় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই আমাদের ছাপোষা জীবনের একঘেয়েমির সালতামামির কোন্খানটায় কালে কালে তাঁর স্থান, তাঁর অমৃতময় নাম স্থান পাবে-- উপরের কথাগুলোর ভিতর বিবৃত করে গেছেন ’আমি তোমাদেরই লোক--“ কে কবে বলতে পেরেছে এত আত্মধী ঘোষণায়, এত প্রত্যয় ভরে
বাভাস-ঘ-৪
আজ যে আমরা তাঁকে ছাড়া এক পা-ও চলতে পারিনা, তাঁকে ব্যতীত আমাদের কোন মনন, বোধি জগৎ নেই, সাংস্কৃতিক জগৎ অন্ধকার, ভবিষ্যৎ লজ্ঝড়ে-- বৌদ্ধিক ভাষা বিবর্ণ-- তা কি আমরা বুঝি! বোধ হয় বুঝতে পারি না পারলে তাঁকে কাছে টেনে নিতে তাঁর প্রতিটি অক্ষরের স্বাদ আস্বাদন করতুম, পূজার অসার অপপ্রয়াসের সুযোগ এত ঘৃণাভরে গ্রহণ ক‘রে তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখতাম না নিজেদের অনাবশ্যক অপাংক্তেয় উপাচারে ভরিয়ে তুলছি-- সেই অর্থে রবীন্দ্রসমুদ্রে ঝাঁপ দিতে পারছি না কারও তো দোষ নয়, দোষ তো আমাদেরই --যারা না বুঝে রবীন্দ্রনাথ বলে বেশি, না প‘ড়ে রবীন্দ্রনাথ প্রচার করে বেশি তাঁর নামটুকু উচ্চারণের মাধ্যমে বাঙালি জাতির বড় দোষ -- সে যে ভিতর থেকে মরে যাচ্ছে, শুকিয়ে যাচ্ছে তার চিন্তার মূলাধার তার বৌদ্ধিক জগৎ, চিন্তার প্রবাহ, মননের আকাশ-- সে বুঝতে পারছে না এ ক্ষেত্রে বন্ধু হয়ে রবীন্দ্রনাথই দাঁড়াতে পারতেন পাশে আমরা ক্রমেই তাঁর ভূমিকা ধূসর করে ফেলছি তাঁকে নিত্যদিনের পূজায় রেখে দিয়েছি আমাদের খেলাঘরে --তাঁকে উপযুক্ত অনুশীলনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছি না তাঁদের মধ্যে যাঁরা এখনও রবীন্দ্ররস আস্বাদনের থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেছেন অথচ আমাদের অজ্ঞানতার আড়ালে একটু একটু করে রবীন্দ্রনাথ আমাদের মানসিক জগৎ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ কি শুধু নামের, শুধু ভক্তির! তিনি কি আমাদের সকলেরই মুক্তির আনন্দ নন! প্রাণের আরাম তো তিনিই আমরা কবে আর বুঝতে পারব তাঁকে, সেই বিশ্বরূপ তুলে ধরা প্রতিভার অলৌকিক উদ্ঘাটন করা-তাঁকে যদি এখনও প্রোথিত না করে দেই এই অস্থির অস্থিতিশীল দিকভ্রষ্ট প্রজন্মের ভিতর-- তাদের শিরায় শিরায়, রক্তের কোষে-- তাহলে খুব বেশি দূরে নেই আমাদের ধ্বংস এত বিপুল ঐশ্বর্য, অতুলনীয় বৈভব, অহংকার নিয়েও আমরা বিশ্বের কাছে করুণার পাত্র হয়ে উঠব হাস্যাস্পদ হয়ে উঠব রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাঙালি জাতীয় জীবনে বৌদ্ধিক গুরু-- সে কথায় যত আহ্লাদ বাড়ে -- ততোটা আহ্লাদই কমে যায়-- যখন রবীন্দ্র রচনাবলীর খণ্ডগুলি শুধু আমাদের বৈঠকখানায় দেয়ালশোভিত ক‘রতে, অনাবশ্যক ভাবে বৎসরের পর বৎসর অপেক্ষা ক‘রছে আজকের অন্তর্জাল আক্রান্ত, মুঠোয়-দুনিয়া গ্রস্ত
বাভাস-ঙ-৫
আধুনিক নতুন প্রজন্ম গৃহ পরিবেশে রবীন্দ্র ভাবনায় উদ্বুদ্ধ না হওয়ায়-- ক্রমশ বাঙালির অন্তরাত্মা কম্পিত শিশুর মনের, কিশোরের মনের, যুবকযুবতীদের মনের কথা যে সুচারু ভাষায় কবিগুরু ব্যক্ত করেছেন-- তা বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয়
কে ভুলতে পারে তাঁর অমল ও দইওয়ালা গল্প, বলাই বা ফটিকের কথা
এ রকম আরও কতই না মণিমাণিক্য ছড়ানো আছে সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্যে আর সেই যে অতিথি গল্পের, পোস্টমাস্টার গল্পের বালকবালিকা তারাপদ আর রতন-!
আসলে নাটক, নভেল, ছোটগল্প, ছড়া, নাটিকা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, সরস হাস্যকৌতুক, অজস্র গান ও সুরারোপ, প্রায় তিন হাজাররে মতো ছবি, নৃত্যনাট্য, নৃত্যমুদ্রা, তাল লয়, ছন্দ সৃষ্টি, রাজনীতির, সমাজনীতির, শিক্ষাপ্রণালীর যে নতুন ভাষ্য তিনি যে-উচ্চগ্রামে বেঁধে দিয়ে গেছেন-- তা থেকে বিচ্যুত হলেই আধুনিক ভাবধারায় কুড়ুল মারারই সমান কে আজ পণ্ডিত আছেন তেমন -- এই বঙ্গদেশে, এই নিখিল বিশ্বে যে তাঁর পাণ্ডিত্যের কাঠগড়ায় রবীন্দ্রভাবনাকে দাঁড় করিয়ে তাঁর সামগ্রিক ও যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারবেন ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা-- ঐশীসংযুক্ত সতত যে প্রবাহ-- মরুবালিরাশি যাকে নিশ্চল করতে পারবে না-- সেই রকম এক দ্যুতিময়, অমৃতময় আদিত্য পুরুষ আমাদের ছা-পোষা বাঙালিদের জীবনে ক্রমে এতটাই ভারী ও ওজনদার হয়ে উঠছেন যে আমরা তাঁর ভার বহন করতে পারছি না-- তাই পূজাপ্রিয় এই জাত তাঁকে কবির আসন থেকে, চিন্তকের আসন থেকে নামিয়ে পূজার বেদীতে বসিয়ে দিয়ে নিয়ত তাঁর বিগ্রহ সম্মুখে পূজারত যা একজন সার্থক,-- একজন সার্বভৌম কবির কাছে কখনই কাম্য হতে পারে না
বাভাস-চ-৬
ভাবাবেগ যতটা না এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, জ্ঞানযোগ ততোটাই কাম্য আমরা এমনকি যারা খানিকটা পড়াশুনার ক্ষেত্রে অগ্রমান-- তারাও না বুঝে, না জেনে তাঁকে বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা কবিদের পাশে বসিয়ে দিয়ে শ্লাঘা অনুভব করি আমাদের কাজ সহজ করে দেই আমাদের নিজেদেরকে বাঁচাতে হলে রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করে থাকা ছাড়া আর অন্য উপায় নেই এখন যেভাবে চারপাশে ঘোর দুর্দিন ক্রমেই আমাদের সবাইকে নাগপাশে বেঁধে ফেলছে তাতে করে আমাদের আরও বেশি করে রবীন্দ্রভাবনার অনুসারী হতে হবে নইলে চার পাশের নাগিনীদের ছড়ানো বিষে ধ্বংস আমাদের অনিবার্য
একথা ঠিক-- বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকার জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথেরই রচনা --কোনও কবির ভাগ্যেই এ রকম বিরল ঘটনা আর ঘটেনি আবার একথাও স্বীকার্য এত বড় বিস্ময়কর প্রতিভাসম্পন্ন কবিকে এতটা অবহেলাও সইতে হয়নি রবীন্দ্রপূজা আজ রবীন্দ্র অবহেলারই সমান পূজা নয়, সম্যক পাঠের মাধ্যমেই হতে পারে আমাদের রবীন্দ্র-অনুভব, আমাদের উত্তরণ-- যা একটা জাতের ক্ষেত্রে কাম্য শুধু বাজার চলতি ভক্তিতে গদগদ হয়ে রবীন্দ্রভক্তি প্রদর্শন করা কাম্য হতে পারে না তিনি তো শুধু বাঙালির নন, ভারতের নন, সারা পৃথিবীর কবি-- তাঁকে আরও বেশি ভাষায় অনুবাদ করে মানুষের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন এ দেশে যারা যোগ্য তাঁদেরকে নিয়ে অনুবাদকমণ্ডলী গঠন করাই যায়
ভাবের ঘরে চুরি না করে একথা স্পষ্টতই বলা যেতে পারে-- কল্লোলগোষ্ঠী, কৃত্তিবাসগোষ্ঠী, আধুনিকগোষ্ঠী-- যারা যখন রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাকে নস্যাৎ করে দিতে তৎপর হয়েছে-- তারা পথের এককোণে পড়ে রয়েছেন-- এগিয়ে যাচ্ছে রবীন্দ্ররথ-- যে রথের রশি ধরে আমাদেরকে তার গতি সচল রাখতেই হবে তবেই না আমাদের মানমর্যাদা বাড়বে বাংলাভাষার সাম্রাজ্য হবে আদিগন্ত, বহুপ্রসারী রবীন্দ্রনাথ আমাদের সোনার ডিম্ব-- সেটা যেমন একদিনেই পাওয়া যায় না, তেমনি তাকে রক্ষা করার প্রয়াসও চালাতে হয় সেটাই আমরা বুঝতে পারছি না দুঃখ একটাই তা-- রবীন্দ্রভক্ত ক্রমশ বর্ধমান-- আর রবীন্দ্রপাঠক
বাভাস-ছ-৭
ক্রমশঃ কমতির দিকে তাঁকে বিগ্রহত্ব দান করে ভক্তবৃন্দ যতই আহ্লাদিত হোক না কেন-- কবি হিসেবে যে তাঁর ক্ষতিসাধন হয়ে চলেছে তা তাঁরা বুঝবেন কবে? রবীন্দ্রনাথই কি তার জন্যে কিছুটা দায়ী! সর্বদাই যেহেতু তিনি চাটুকার পরিবৃত হয়ে থাকতেন-- তা তো বলাই যায় তাই কি শেষের দিকে তিনি ছটফট করতে করতে ছবির অঙ্গনে পদার্পণ করলেন!
আজ যে চারপাশে তাঁর সার্ধশতবর্ষের ভিতর বাংলা তথা বাঙালিরা ঘূর্ণায়মান তাতে তো সেটাই প্রমাণিত--শুধু ভাব, শুধু পূজা কোথায় তাঁর যোগ্য অনুবাদ, কোথায় তাঁর ভাবনার প্রসার শুধু অনুষ্ঠান, শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণা, শুধু তর্পণ, শুধু অসার সংকেত-- তাতে খুব বেশি একটা লাভ নেই চারপাশে তাঁর মূর্তি বসলেও তাঁকে সামগ্রিকতায় ধরা যাচ্ছে না অথচ আমরা স্থূলকথায় বলতেই পারি প্রতিভার ঔৎকর্ষে তিনি দান্তেকে তো বটেই জার্মান কবি গ্যেটেকেও ছাড়িয়ে গেছেন তা যতই কিছু কিছু অধ্যাপক-পণ্ডিতপ্রবর ভিন্নমত পোষণ করুন না কেন
যুগ আসবে, যুগ চলেও যাবে কালের কপোলে জমছে ধুলোর আস্তরণ, সতত পরিবর্তনশীল এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কতই না ওলট পালট হয়ে যাবে-- তবুও ঈশ্বরপ্রসাদপুস্ট হয়ে যদি বাঙালি জাতি বরাত জোরে বেঁচে থাকে -- তাহলে তাকে হতেই হবে রবীন্দ্রভাবনার ধারক ও বাহক আশ্রয় তাঁর কাছে নিতেই হবে বৌদ্ধিক জগতে বিশেষত-- বাঙালির বৌদ্ধিক জগতে এত বড় বিস্ময়কর প্রাপ্তি আর কোনও দিনই ঘটবে না তিনি তাই আমাদের জাতীয় জীবনে দৈব আবির্ভাব ’কবিগুরু তোমার প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই--‘ শরৎচন্দ্রীয় ঘোষণা এখনও অপ্রাসঙ্গিক হয়নি সত্যিই বিস্ময়-- ঈশ্বরের সেই বিস্ময়কর দানকে আস্বাদন করার জন্য বাঙালির ঘরে ঘরে রবীন্দ্রপ্রতিভা-- বিগ্রহের চক্রে নষ্ট না হোক -- রবীন্দ্রনাথ বহুলভাবে পঠিত হোন-- তাহলে যুগপৎ আমাদের মুক্তি, আমাদের আনন্দ, আমাদের উত্তরণ যে জাতির উত্তরণ নেই --বিবর্তনও তার থাকার কথা নয় সেটা বিশাল ভাণ্ডারের অধিকারী হয়ে বাঙালি কবে বুঝবে? আমরা বাঙালিদের সেই দিকটার দিকেই তাকিয়ে আছি-- যেহেতু রবীন্দ্রনাথই আমাদের জীবনে সেই অমৃতবর্ষণকারী শাশ্বত মূল্যবোধের জাজ্বল্যমান আদিত্য পুরুষ -- যার স্পর্শে আবারও আমরা বিশ্বে শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করতে পারব
=======================
জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান তাঁদের তথ্য আমাদের কাছে জমা দিন আমরা তাঁদের কথা প্রকাশ করব
বাভাস-জ-৮
শিশু মনে রবির কিরণ
স্বপন বিশ্বাস
বর্যণ ক্লান্ত মেঘলা বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে যখন আমার দখিনের ছোট্ট বারান্দায় একান্তে বসি, তখন অন্য এক ভাবনার অন্য এক ছবি ভাসে-- এই তো সেই শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২শে শ্রাবণ রাখীপূর্ণিমার প্রভাত বেলায় তাঁর ঝুলিতে যত সম্পদ ছিল সব আমাদের উজাড় করে দিয়ে জনসমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে প্রকৃতিঋদ্ধ কবি নিঃশব্দে চলে গেলেন তাঁর নিবিড় সাধনোচিত ধামে দিয়ে গেলেন সত্য-শিব ও সুন্দরের পবিত্র মন্ত্র বলে গেলেন--
”তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে, হে ছলনাময়ী । ...“
তাঁর প্রতিভার সহস্রধারা প্রতিভাত হয় আমাদের জীবনে-মননে, প্রেমে-অপ্রেমে, সংকটে, কৌতুকে, বেদনায়, বিরহে, বিজ্ঞানে কবির সাবলীল বিচরণ আমাদের বিস্মিত করে আমাদের সমৃদ্ধ করে শিশুদের জন্য হাস্যরসাত্মক কাহিনি, গল্প, নাটক, রূপকথা, ছড়া, কবিতা-- বাংলা সাহিত্যে এসবের যথেষ্ট প্রাচুর্য না থাকায় শিশুরা বঞ্চিত হয় আধুনিক বিজ্ঞান সভ্যতায় ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দাপটে শিশুর কল্পনার জগৎও হারিয়ে যেতে বসেছে বাদ্য-সর্বস্ব সংগীত, হিন্দি-ইংরেজি ছবির অনুকরণে স্বকীয়তা হারানো বাংলা চলচ্চিত্র, দূরদর্শনের অযৌক্তিক, আর অবিশ্বাস্য কাহিনির মেগা সিরিয়ালের উপস্থাপনা আর বিপণনের স্বার্থে অযথা যৌন বিজ্ঞাপনের কবলে তিলে তিলে শিশুরা নিঃশব্দে শৈশব হারাচ্ছে
কোনও শিশুর কাছেই এখন কোনও বিস্ময় বা কৌতূহল নেই বর্তমানে এই সব
বাভাস-ঝ-৯
শিশুদের অন্তঃসার শূন্য কল্পনারাজ্যে রবীন্দ্রনাথই ভরসা দেন রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেকটি নাটক যেমন মঞ্চ-সফল করা কঠিন হয়ে পড়ে, তেমনি তাঁর সব উপন্যাস আমাদের আশা পূরণ করতে সক্ষম হয় না, অথচ শিশুদের বিচিত্র ভাবনায় ভরা মনের জগৎটাকে এমন করে রবীন্দ্রনাথের মতন কেউই আবিষ্কার করতে পারেননি
রবীন্দ্রনাথের শৈশব কেটেছে চার দেওয়ালের নিষ্পেষণে একান্ত নিঃসঙ্গতা নিয়ে কড়া শাসনের বেড়াজালে আশৈশব ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছেন সারাক্ষণ শিশু রবীন্দ্রনাথকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পড়তে হত, অন্যথা হলে মেজদাদা হেমেন্দ্রনাথের কড়া শাসনে প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার উপক্রম হত সারাদিনের বজ্রকঠিন রুটিনে রবীন্দ্রনাথের প্রাণটা বুঝি শরীর থেকে বেরিয়ে যায়! ভোর হতেই কানা পালোয়ানের কাছে কুস্তির তালিম নেওয়া, বিষ্ণু, শ্রীকণ্ঠবাবু, ওস্তাদ যদুভট্টদের কাছে বিভিন্ন ধরনের সংগীতের শিক্ষা নেওয়া টিউটর নীলকমল মাস্টার ছিলেন খুব কড়া লোক, সময়কে সর্বদা খুব গুরুত্ব দিতেন এছাড়া, হেরম্ব তর্করত্ন, বিজ্ঞানের জন্য সতীনাথ দত্ত, ইংরেজি শিক্ষা দিতেন অঘোর মাস্টার ভৃত্যদের মধ্যে নীলমণি ছিল বড় মাতব্বর লোক তাঁর শাসনে এক মিনিটও এপাশ ওপাশ করার জো ছিল না
রবীন্দ্রনাথের জীবনে শৈশব স্বভাবিক নিয়মে এলেও অন্য শিশুদের মতো তিনি শৈশবকে উপলব্ধি করতে পারেননি সেই আক্ষেপ তাঁকে বার বার পীড়িত করেছে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন-- ”গাড়ি সবুজ প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে চলছিল তখন মনে হচ্ছিল নিজে দৌড়ে ছুটে পালাচ্ছি...“ না-পাওয়ার বেদনা থেকেই হয়তো কবির জীবনে-মননে শিশুসাহিত্যের এত বড় ঠাঁই নিজের ভিতরে আজীবন কোমল প্রাণ এক শিশুকে লালন করেছেন
রবীন্দ্রভাবনায় শিশু কবিকল্পনা-সঞ্জাত অমূর্ত ভাবনা মাত্র নয় রবীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্য মনোজগতের বিচ্ছিন্ন কোনও প্রকাশ কিংবা সংযোজন নয় সামগ্রিক সাংস্কৃতিক জীবনের অপরিহার্য অংশ রবীন্দ্রনাথের লেখনী থেকে শিশুদের প্রাপ্তি হয় অনাবিল মজা, কৌতুক, বিস্ময়, বীরত্ব এবং আনন্দরস
রবীন্দ্রনাথের শিশুকেন্দ্রিক সাহিত্যের দুটি ধারা --(১) শিশুকে নিয়ে রচনা, (২) শিশুর জন্য রচনা যেমন ’বিচিত্র সাধ‘ কবিতায় সতৃষ্ণ-চোখ শিশু বাধা বন্ধনহীন ফেরিওয়ালার মতন স্বাধীনভাবে চলার কথা ভাবে
বাভাস-ঞ-১০
”রাত হয়ে যায় দশটা এগারোটা/কেউতো কিছু বলে না তার লাগি / ইচ্ছে করে পাহারাওয়ালা হয়ে / গলির ধারে আপন মনে জাগি“
ডাকঘর:
অমল --জানো ফকির, আমাকে একজন বলেছে আমি ভালো হয়ে উঠলে সে আমাকে ভিক্ষা করতে শেখাবে আমি তার সাথে যেখানে খুশি ভিক্ষা করে বেড়াব
আবার বন্ধনহীন উল্লাসে শিশু বলছে-- ”কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা...“ শিশুর জগতে এসে আকাশ আর পৃথিবী কোথায় যেন এক বিন্দুতে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে কবি শৈশবে নিবিড়ভাবে মাকে পাননি আর পাননি বলেই তাঁর অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কবিতায়--
”মা যদি তুই আকাশ হতিস
আমি চাঁপার গাছ
তোর সাথে মোর বিনি কথায়
হত কথার নাচ“
মাকে নিবিড় করে কাছে পাওয়ার ইচ্ছেয় বলেছেন,
”তোমার বুকে মুখটি গুঁজে
ঘুমেতে চোখ আসবে বুঁজে“
আবার মায়ের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে বলেছেন--
”তোমার কাছে আমিই দুষ্টু
ভালো যে আর সবাই“
আবার সে শিশু মনের আবেগকে ব্যক্ত করে বলেছে,
”মাকে আমার পাড়ে না মনে
শুধু যখন বসি গিয়ে
শোবার ঘরের কোণে,
জানলা থেকে তাকাই দূরে
নীল আকাশের দিকে
মনে হয়, মা আমার পানে
চাইছে অনিমিখে“
আবার ’শিশুপাঠ‘ ছড়ায় সহজ বিন্যাসের আয়োজন লক্ষ করি--
ক্ষান্ত বুড়ির দিদিশাশুড়ির
পাঁচ বোন থাকে কালনায়
শাড়িগুলো তারা উনুনে বিছায়
হাঁড়িগুলো রাখে আলনায়“...
বাভাস-ট-১১
ছন্দের দুলুনি শিশুমনের চঞ্চলতার দোসর যেমন -
”অল্পেতে খুশি হবে
দামোদর শেঠ কি
মুড়কির মোয়া চাই,
চাই ভাজা ভেটকি, ...“
আবার ছড়ার মজায় শিশুর যত ভয় নিরুদ্দেশ হয়ে যায়-
”ভূত হয়ে দেখা দিলে
বড় কোলা ব্যাঙ
এক পা টেবিলে রাখে
কাঁধে এক ঠ্যাঙ“ (খাপছাড়া)
শিশুর দুঃসাহসিক অভিযানের ইচ্ছা প্রকাশ হয়--
”হাতে লাঠি মাথায় ঝাঁকড়া চুল
কানে তাদের গোঁজা জবা ফুল
আমি বলি দাঁড়া খবরদার
এক পা কাছে আসিস যদি আর
এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার
টুকরো করে দেব তোদের সেরে...“
(’বীরপুরুষ‘-- শিশু)
নাটকও পেয়ে যায় বন্ধনহারা ছুটির গান --
”মেঘের কোলে রোদ হেসেছে
বাদল গেছে টুটি
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই,
আজ আমাদের ছুটি“
এখানে ’ছুটি‘ মানে থেমে থাকা নয়
’শিশু ভোলানাথ‘-এর ”দুয়োরানি“ কবিতায়
”... বাঘ ভাল্লুক অনেক আছে
আসবে না কেউ তোমার কাছে
দিনরাত্রি কোমর বেঁধে
থাকব পাহারাতে“
‘খাপছাড়া‘-র প্রারম্ভে কবি স্বীকার করেছেন
”সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে
সহজ কথা যায় না লেখা সহজে...“
বাভাস-ঠ-১২
অন্যান্য লেখাতেও যেসব শিশু চরিত্র আমরা পাই কবি তাদের রূপ দিয়েছেন অত্যন্ত যত্নে ও আদরে যেমন-- ’পোস্টমাস্টার‘-এ রতন, ’ব্যবধান‘-এ বনময়, ’কাবুলিওয়ালা‘-তে মিনি, ’ছুটি‘তে ফটিক, ’অতিথি-তে তারাপদ --এমনি কত কত ছোটদের রবীন্দ্রনাথ একান্ত দরদী মনে লালন করেছেন এসব সম্পর্কে আরও অনেক অনেক লেখার ছিল কিন্তু পরিসরের অভাবে তা সম্ভব হল না
পরিশেষে বলি-- শিশুমনে রবীন্দ্রনাথের বিচরণ সকল শিশুর কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে রইল
রবীন্দ্রনাথ যে বন্দী শৈশব অনুভব করেছেন, পীড়িত হয়েছেন, আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে শিশুরা আরও ভয়াবহ আবর্তে পাক খাচ্ছে আমাদের শহুরে সময়ের গুণে মানসিক বন্ধনও
শিশুর কঠিন পরিণাম শিশুর প্রতি আমাদের অস্বাভাবিক দাবি, আদর, টিভি চ্যানেলের বাণিজ্য বিনোদন, সামাজিক অস্থিরতা --এতে শিশুর শৈশব অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে আজকের এই দুঃসময়ে শিশুমনে রবীন্দ্র-আশ্রয় বড় প্রয়োজন
===================
বাভাস-ড-১৩
”জীবের মধ্যে সবচেয়ে সম্পূর্ণতা মানুষের। কিন্তু সবচেয়ে অসম্পূর্ণ হয়ে সে জন্মগ্রহণ করে। বাঘ ভালুক তার জীবনযাত্রার পনেরো-আনা মূলধন নিয়ে আসে প্রকৃতির মালখানা থেকে। জীবরঙ্গভূমিতে মানুষ এসে দেখা দেয় দুই শূন্য হাতে মুঠো বেঁধে।“
-- বাংলাভাষা পরিচয়
========================
” নিদ্রাহারা রাতের এ গান
বাঁধব আমি কেমন সুরে।
কোন্ রজনীগন্ধা হতে
কোন্ রজনীগন্ধা হতে
আনব সে তান কন্ঠে পূরে
সুরের কাঙাল আমার ব্যথা
সুরের কাঙাল আমার ব্যথা
ছায়ার কাঙাল রৌদ্র যথা
সাঁঝ-সকালে বনের পথে
সাঁঝ-সকালে বনের পথে
উদাস হয়ে বেড়ায় ঘুরে
ওগো, সে কোন্ বিহান বেলায়
ওগো, সে কোন্ বিহান বেলায়
এই পথে কার পায়ের তলে
নাম-না-জানা তৃণকুসুম
নাম-না-জানা তৃণকুসুম
শিউরেছিল শিশিরজলে।
অলকে তার একটি গুছি
অলকে তার একটি গুছি
করবীফুল রক্তরুচি,
নয়ন করে কী ফুল চয়ন
নয়ন করে কী ফুল চয়ন
নীল গগনে দূরে দূরে “
বাভাস-ঢ-১৪
”যে সংসারে প্রথম চোখ মেলেছিলুম সে ছিল অতি নিভৃত। শহরের বাইরে শহরতলীর মতো, চারি দিকে প্রতিবেশির ঘরবাড়িতে কলরবে আকাশটাকে আঁট করে বাঁধে নি।
আমাদের পরিবার আমার জন্মের পূর্বেই সমাজের নোঙর তুলে দূরে বাঁধা-ঘাটের বাইরে এসে ভিড়েছিল। আচার-অনুশাসন ক্রিয়াকর্ম সেখানে সমস্তই বিরল।
আমাদের ছিল মস্ত একটা সাবেক কালের বাড়ি, তার ছিল গোটাকতক ভাঙা ঢাল বর্শা ও মরচে-পড়া তলোয়ার-খাটানো দেউড়ি, ঠাকুরদালান, তিন-চারটে উঠোন, সদর-অন্দরের বাগান, সংবৎসরের গঙ্গাজল ধরে রাখবার মোটা মোটা জালা-সাজানো অন্ধকার ঘর। পূর্বযুগের নানা পালপার্বনের পর্যায় নানা কলেবরে সাজে সজ্জায় তার মধ্য দিয়ে একদিন চলাচল করেছিল, আমি তার স্মৃতিরও বাইরে পড়ে গেছি। আমি এসেছি যখন, এ বাসায় তখন পুরাতন কাল সদ্য বিদায় নিয়েছে, নতুন কাল সবে এসে নামল, তার আসবাবপত্র তখনো এসে পোঁছয়নি।“
বাভাস-ণ-১৫
”ছেলেবেলা থেকেই এত অসম্ভব-রকম বেশি পড়েছি যে পাশ করতে পারি নি। যতখানি কম পড়া পাস করার পক্ষে অত্যাবশ্যক, তার সময় আমার ছিল না।
আমি ফেল-করা ছেলে বলে আমার একটা মস্ত সুবিধে এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘড়ায় বিদ্যার তোলা জলে আমার স্নান নয় স্রোতের জলে অবগাহনই আমার অভ্যাস। আজকাল আমার কাছে অনেক বি. এ., এম. এ. এসে থাকে; তারা যতই আধুনিক হোক, আজও তারা ভিক্টোরীয় যুগের নজরবন্দী হয়ে বসে আছে। তাদের বিদ্যার জগৎ টলেমির পৃথিবীর মতো, আঠারো-উনিশ শতাব্দীর সঙ্গে একেবারে যেন ইস্ক্রু দিয়ে আঁটা; বাংলাদেশের ছাত্রের দল পুত্রপৌত্রাদিক্রমে তাকেই যেন চিরকাল প্রদক্ষিণ করতে থাকবে।“
--গল্প গুচ্ছ পয়লা নম্বর
বাভাস-ত-১৬
বাভাস-- বাংলাভাষা সমিতির পত্রিকা ১ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা
2 comments:
Wholesale Silver Gifts
Superb post I must say. Very simple but yet entertaining and engaging.. Keep up the wonderful work!
সাধু মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ অন্য সংখ্যাগুলিও পড়ার অনুরোধ জানাই
সম্পাদক
বাভাস
বাংলা ভাষা সমিতি
কোলকাতা
Post a Comment